ফামিওহার সংসার

কাজী সাহেব চশমা ফেলে এসেছেন। টিউব লাইটের আলোতেও পড়তে সমস্যা হচ্ছে। পাত্রের পাশে বসে নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করছে কিন্তু লিখতে পারছে না। বিবাহ নিবন্ধন খাতার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। খুব কাছ থেকে দেখেও মনে হচ্ছে উনি তথ্য ভুল লিখবেন। ন্যাশনাল আইডি কার্ডের তের ডিজিট উনি বার ডিজিট লিখবেন। কাটাকাটি করে আবার লিখবেন। বিয়ের শুরুতেই কাটাকুটি হবে। নিশ্চয়ই শুভ লক্ষন না। কিন্তু এইসব ভেবে এখন কোন লাভ নেই।
ফামিহা অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠেছে। এরপর থেকে ডেকেই যাচ্ছে। আজ শুক্রবার বলে একটু ঘুমাতে দিবে না। মিওহা বিরক্ত হয়ে ঘুম থেকে উঠেই দেখে ফামিহা চা নিয়ে অপেক্ষা করছে। বারান্দায় বসে চা খাবে। বিয়ের পর থেকেই মিওহা স্বপ্ন দেখে আসছে ফামিহা চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে থেকে ডেকে তুলবে। এরপর মিওহা একটু আড়মোড় দিবে। উঠতে চাইবে না। কিন্তু আজ দেখি স্বপ্ন সত্যি হয়ে যাচ্ছে।
উঠো তো... চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
মিওহা এক লাফে বিছানা থেকে নেম যায়। সে ভেবে পায় না এখন কি ফ্রেশ হয়ে চা খাবে নাকি বারান্দায় দাড়িয়ে চা খেয়ে ফ্রেশ হবে। শুধু তাকিয়ে আছে ফামিহার দিকে। যেন কি ঘটছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
সোনালী মিষ্টি রোদের আলোয় বারান্দাটায় চকচক করছে। লতানো কয়েকটা গাছ লাগানো আছে। শরতের মৃদু হাওয়ায় গাছের পাতাগুলো দোল খাচ্ছে। দুইটা চেয়ার পাশাপাশি রাখা। সামনের বাসার বারান্দায় কয়েক জোড়া লাভবার্ড পাখি আছে। কিচিরমিচির করছে।
আজ শুক্রবার মনে আছে তো? ফামিহা এই কথা বলে চায়ে চুমুক দি‍য়ে চেয়ারের উপরে খুব আরামে পা তুলে বসলো। আমি ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করতেই মনে পড়ে গেলো আজ সারাদিন আমার ছুটি। ফামিহা রেষ্ট নিবে আর আমি সারাদিন কাজ করব। খুব বড় না হলেও একটা লিষ্ট হাতে ধরিয়ে দিল। মনে হচ্ছে সারা সপ্তাহে তার একটাই কাজ ছিল বাজার নিয়ে আসার জন্য লিস্ট করা। আজ দুপুরে আর রাতে কিন্তু রান্না হচ্ছে না।
কেন? বাইরে খাবে?
অনেকদিন কোথাও দুজনে বাইরে যাই না। তুমি তো অফিস নিয়েই ব্যস্ত থাকো।
আজ দূরে যাই চলো। আমি শাড়ি পড়ব আর তুমি পাঞ্জাবি। একটা গাড়ি ভাড়া করতে পারবে? থাক। রিক্সায় করে যাব। যেখানে রিক্সা যাবে না সেখানে নেমে হাত ধরে হেটে যাব। আজ সারাদিন নন মটরাইজ ভিহিক্যালে করে ঘুরব।
বাইরে ঘুরার কথা মনে হলেই মিওহা ধানমন্ডি লেক ছাড়া আর কোথাও চিনে না। আসলে দূরে যেতে ইচ্ছে করে না। দশ টাকার বাদাম খেয়ে ঘন্টাখানেক গল্প করেই মিওহা বাসায় চলে আসবে। এসে ঘুম।
ফামিহা স্থিরভাবেই বসে আছে। কিন্তু মনের ভিতরে যে অস্থিরতা সেটা খুব চেপে রেখেছে। চোখের পাতা খুব দ্রুত ফেলছে। হাল্কা গোলাপী শাড়ী পরে আমাদের সামনে বসে আছে। বিয়ের ভাইবা বোর্ডের জুড়ির সামনে সে বসে আছে আর একের পর এক প্রশ্ন করছে। কিন্তু সে চটপটে সব উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। ফাহিমার অস্থিরতার চেয়ে আমি বেশি অস্থির হয়ে যাচ্ছি। আমাকে কোন প্রশ্ন করলে আমি নিশ্চিত কোন উত্তর দেওয়ার মত মুখ দিয়ে শব্দ বের হবে না।
বাবা, তোমার অফিস কোথায়?
ভিজিং কার্ড এগিয়ে দিতেই মুরুব্বি বলেই বসল, বাবা মুখেই বল, কাগজ লাগবে না।
বনানী। আমাদের বাসার সবার গলার স্বর উচ্চ। কিন্তু এইখানে এসে আমি কেমন মৃদুভাষী হয়ে গেলাম। এই জীবনে যদিও কোন ভাইবা বোর্ডে ভালমত উত্তর দিতে পারি নাই। আজও বুঝি আমি উত্তর দিতে পারব না। আচ্ছা এরপর কি জব ডেস্ক্রিবশনস জিজ্ঞেস করবে? কি কথা জিজ্ঞেস করল জানি না আমি শুধু কিছু একটা বলেছি আর উনারা কি বুঝেছে উনারাই জানেন।
বিয়ের সময় পাত্রের দৌড় দিতে ইচ্ছে করলে কি করা যেতে পারে। একটা ভো দৌড় দিলে কেমন হবে? একটু আগেই শ্বাস্রুদ্ধ কিছু সময় গিয়েছে। পাঁচ মিনিট আগেও এই বাড়ি, মানুষগুলো, আর তাকে কেমন অপরচিত লাগছিল। কিন্তু এক কথাতেই সব পালটে গেল। পাত্র পাত্রীপক্ষ আলহামদুল্লিলাহ বলেই একে অপরকে মিষ্টি মুখ করাচ্ছে। মিওহা বাইরে এসেছে চা খেতে। প্রচন্ড মাথা ধরেছে। কয়েকজায়াগায় ফোন দেওয়া জরুরী। বাড়ির ভিতরের হৈচৈ এ ফোন দিয়ে কথা বলা যাবে না।
কাজী সাহেবর লিখা পর্ব নির্ভুল্ভাবেই শেষ হয়েছে। আমি বসে আছি সোফায়। চারদিকে উৎসব পরিবেশ। কয়েকজন কাছে এসে ছবি তুলছে। আমি রোবটের মত মুখে হাসি ভাব নিয়ে বসে আছি। এইটাই আপাদত আমার কাজ। স্যুটের ভিতর দিয়ে ঘাম পিঠ গড়াচ্ছে।

Comments

Popular posts from this blog

হাওরের হাওয়ায়

Could You Remember?

টেলিফোন কল