একা আমার এই আমি

ফেব্রুয়ারী ২৮, ২০০৯

ভারী কুয়াশার শীতের সকাল। মনটা ভীষন খারাপ করে বসে আছি আর কিছুক্ষন পর পর চোখের পানি মুছতেছি। খুব কষ্টের মাঝেও আনন্দ হচ্ছিল। তবে আনন্দ বা কষ্ট যাই ছিল সবকিছুর জন্য দোষ দিয়েছি আমার স্যার (খালেদ হাসান)-কে। তার জন্যই আমাকে গাজিপুর ছেড়ে সিলেট যেতে হবে। তিনি যদি ভর্তি করার জন্য এমন না করতেন তবে আজ ফ্যমিলির সাথে-ই গাজিপুর থাকতে পারতাম। কিন্তু পরে আদৌ কি কোথাও কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতাম কিনা জানি না। তাতে কি অন্তঃত গাজিপুরতো ছাড়তে হত না। এখন এসব ভেবে লাভ নেই তাই মনে যত কষ্ট আর ক্ষোভ থাকুক আমাকে সিলেট যেতেই হবে আর এখন আমার ব্যগ গোছাতে হবে।

মা আর মারুফ ভাইয়া কি করছে কিছুতেই মনোযোগ নেই। বাবা মেসে থাকার জন্য নতুন বিছানার চাদর, বালিশের কাভার, মশারি কিনে এনেছে। মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। এখন থেকে আমাকে একা থাকতে হবে, নিজে-কে নিয়ে খেতে হবে। মা আর রাত জেগে খাঁ খাঁ করবে না। আমিও আর এটা খাব না ওটা খাব না এমন করবো না। আবার চোখে পানি চলে এসে গেলো।

রাতের ট্রেন উপবন সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে।। দুপুরে খেয়ে ঘুমাতে পারলাম না। কম্পিউটারে যত কষ্টের গান ছিল (মানে না মন বুঝে না ব্যথা..., ফেরারি এ মনটা আমার..., কারে দেখাব মনের দুঃখ গো...ইত্যাদি ) সব গান একাধিকবার করে শুনে ফেলেছি। যতই গান শুনি ততবারই কান্নায় দুচোখের পানি গাল বেয়ে পড়ে একাকার অবস্থা। কিন্তু কিছুতেই সিলেট যাওয়া বন্ধ করা যাবে না। আবারও কান্না।অবশেষে বাবার আছ থেকে বিদায় নিয়ে সিলেটের পথে। বাসা ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছি। সব মায়া ফেলে দিয়ে। আমার ঘর, আমার পড়ার টেবিল, আমার ফুল গাছ। সব কিছুই ছেড়ে। আর আমি পড়ার টেবিলে বসে জোরে জোরে পড়ব না ( ভাল ছাত্র সাজার জন্য ), পাশের বাড়ির কেঊ বলবে না ছেলেড়া কত পড়ে, আমার গাছগুলো-তে সময় করে পানি দেয়া হবে না। আর পানির অপেক্ষায় থেকে থেকে মাটি আর শিকড় শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে।



মার্চ ১, ২০০৯

শীতের সকালে কুয়াশা ভেজা ভোরের আলোয় সিলেট রেলষ্টেশন দেখা গেল। মা, ভাইয়া আর আমি এখন সিলেট। অচেনা শহরে। যদিও এর আগে দুইবার এসেছি কিন্তু এইবার অচেনা শহরে নিজকে খুজে পেতে হবে তাই অচেনা এখন চেনা শহর বলতেই হবে।বাড়ীর বাইরে আমি কখনো থাকিনি। আর এত দূরে তো আরো না। কিন্তু এইবার আর না থেকে উপায় নেই। তাই মেসে উঠতেই হবে। আমার জীবনের প্রথম মেসে থাকা হবে এটা। এতগুলা অচেনা মানুষের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ানো ভাবতেই কেমন জানি চুপশে যাই। আমি মরেই যাব। মেসে সিট ঠিক করে দিল আমার ভাইয়ার বন্ধু বাহার ভাই। তার বন্ধু সাব্বির ভাই-দের মেস। সুরমা, আখালি যেতেই মেস দেখে বড় ধরনের ধাক্কা খেলাম । পুরা দেখতে জেলখানা আর নোংরা মনে হচ্ছিল। বাড়ির ভিতর গিয়ে আরো টাশকি খেলাম। দম বন্ধ করা পরিবেশ। দিনের বেলায় যেন মনে হল মধ্য রাত। দরজা খুলে দিল সাব্বির ভাই। তারপর আমার রুমের দরজা খুলে দিল চিন্ময় ভাই। সবাই ঘুমে ছিল। মেসের সবাই আমার বড় ভাই। ( ৮ জন থেকে ২ জন জুনিওর, আমি আর নিলয়) । সিএসই ডিপার্টমেন্ট। নিলয় ঢাকায় ছুটিতে তাই সে কেমন ছেলে কোন ধারনা পেলাম না। আর বাকি সব ভাইয়াই ( সোহান ভাই, মাহমুদ ভাই, ছোটন ভাই, জাভেদ ভাই)ঘরে এসে পরিচিত হয়ে গেল। পরের সময়গুলো বেশ করেই কেটে গেল। মা আর ভাইয়া মিলে আমারা জাফলং, দুই মাজার ঘুরে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় চলে গেলাম। সিলেটে এসে আমি প্রথম রাত মেসে কাটাতে পারিনি।



মার্চ ২, ২০০৯

পরদিন সকালে ক্লাস করবো তাই ভোরে (গোলাপগঞ্জ ) থেকে রওনা হলাম। এসে দেখি আমার রুমমেট্ ভাইয়া ঘরে তালা মেরে ক্লাসে চলে গেছে। আজ আর বই খাতা নিয়ে ক্লাসে যাওয়া হল না। তাই মা, আমি, ভাইয়া বেরিয়ে পড়লাম বিশ্ববিদ্যালয় দেখব আর ফোনে কথা বলা বন্ধু (শাহরিয়া)র কাছ থেকে ক্লাস ও অন্যান্য সব জেনে নিয়ে আগামীকাল থেকে ক্লাস শুরু করব।বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে প্রথমেই দেখা হল শাহরিয়া'র সাথে। ভাইয়া বলল ঘুরে দেখে আসতে। সে আমাকে নিয়ে গেল D-Building এর পিছনে। সেখানে কয়েকজন বসে গল্প করছে ( মেজবাহ, স্বপন, বিপু, আরাফাত, নয়ন, ওসমান,প্রবাল, পলাশ ভাই আরো বেশ কয়েকজন। নাম মনে করতে পারছি না)। আমাকে দেখেই প্রথমে একটু ভাব নিয়ে নাম জিজ্ঞেস করল। এরপর শুরু করল উল্টা পাল্টা কথা। আমি পুরা হচকিয়ে গেলাম। সবাই যা করল তাকে এককথায় বলে আমাকে র‍্যাগ দিলো। আমি ভয়ে লাল হয়ে কাদঁ কাদঁ অবস্থা। হা হা হা হা...। দোস্ত (মেজবাহ, স্বপন, আরাফাত, প্রবাল, পলাশ ভাই বিপু...আর নাম ভুলে যাওয়া বন্ধুরা) সত্যি অসাধারন লেগেছিল। যদি বলি আমার ক্যাপাসে প্রিয় জায়গা কোনটা আমি বলব D-Building এর পিছনের সেই গাছ তলা। এরপর ঘুরে এসে দুপুরে মেসে খেলাম। বিকেলে চৌকি, টেবিল, তোশক আর যা যা লাগে কিনে নিলাম। রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম মেসে আমার বিছানায়।


মার্চ ৩, ২০০৯

ক্লাস করেছি। কিন্তু কেমন জানি লাগছিল। পুরা অচেনা একজন। আমি চিনি শুধু লিজা নামের একটী মেয়ে-কে যে আমার সাথে ভর্তি হয়েছিল আর শাহরিয়া। বেশ একটা না দুইটা ক্লাস করে মেসে ফিরে এলাম। তবে সকাল থেকেই আবার মন খারাপ। কান্না আসে আসে ভাব। ভাইয়া আর মা আজ সিলেট থেকে চলে যাবে। এইবার সত্যি একা হয়ে যাবার পালা। মা সাব্বির ভাই-কে যখন বলল আমার ছোট ছেলে একটু দেখে রেখো আমি আর নিজেকে সাম্লাতে পারলাম না। হু হু করে কেদে ফেললাম। ট্রেন দুপুরে। খেয়ে রেলষ্টেশনে ট্রেন ছড়ার অপেক্ষা। বুকটা ধুক ধুক করছে। মার চোখের কোনায় পানি। সময়ের শেষ প্রান্তে। ট্রেন থেকে নেম গেলাম। জানালার পশে মা বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমি একা নিচে দাঁড়িয়ে। ট্রেনের হুইসেলের সাথে সাথে আমার চোখের পানি টপ টপ করে পড়তে লাগল। ইচ্ছে করছিল ট্রেন থামিয়ে তাদের সাথে চলে যাই। খুব একা লাগছিল। জোরে জোরে কাদলাম। মা দূরে যতদুর জানালা দিয়ে দেখা যায় আমার দিকে তাকিয়ে রইল। ভাইয়াকে দেখলাম না। ভাইয়ার জন্য ভীষন কান্না পাচ্ছিল। সে কেমন করে আমাকে একা রেখে ফেলে চলে গেল। এখন আমি কি করব। কেমনে থাকব? রেলষ্টেশনে বসে আঁধ একঘন্টা কাদলাম। এরপর আস্তে আস্তে মেসে ফিরে গেলাম।রাতের আধারে কেদেঁ কেদেঁ বালিশের কাভার ভিজিয়েছি এখন ভাবলে খুব মজা লাগে। ফোনে কথা বলতে পারতাম না চোখের পানির মুছতে মুছতে। প্রতিটি সময়গুলোকে বছর লাগত। কবে ২৬ মার্চ আসবে আমি বাসায় যাব আর ভেবে ভেবে কাদঁতাম কেন সময় যায় না।


অক্টোবর ১৩, ২০১১

প্রায় তিনটি বছর কেটে যাচ্ছে এই সিলেট শহরে। সেই অচেনা সিলেট শহর এখন কত চেনা। সেই অচেনা মানুশগুলো আজ খুব কাছের আর প্রানের। যেন তাদের জন্যই তাদের কাছে থাকার জন্যই আমার সিলেটে আসা। কিছু মানুষ পড়ালেখা শেষ করে আমাকে আবার একা ্করে রেখে গেছে (আমার প্রথম মেস মেম্বার- সাব্বির ভাই, মাহমুদ ভাই, সোহান ভাই, ছোটন ভাই, জাভেদ ভাই, জাহিদ ভাই, সালাম ভাই, নিলয় )। তবে নতুন কিছু বন্ধু পেয়েছি আমার বর্তমান মেস মেম্বার - অভি, ইকবাল, তানিম, ( মইনুল আমার রুম মেট)। আর আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা যাদের ছাড়া আমি সিলেটে একা।মনটা খারাপ হয়ে যায় যখন ভাবি আবার তো তাদের ছেড়ে যাব একদিন। কান্নায় এখন-ই চোখের কোনে পানি জমে শুধুই আমার বন্ধু আর আমার প্রিয় এই সিলেট শহরে জন্য। আবার আমার এই আমি একা হয়ে যাব শুধু-ই তাদের হারিয়ে।

Comments

Popular posts from this blog

হাওরের হাওয়ায়

Could You Remember?

টেলিফোন কল